প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস

 

১.১ প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস

১৯৭৪ সালে একদল আলোকিত ও আত্মনিবেদিত সমাজ হিতৈষী বৌদ্ধ ভিক্ষু কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মোনঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। মোনঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিলো পার্বত্য অঞ্চলের অনাথ অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করে তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। মোনঘরের সংবিধানে বর্ণিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিপূরণের লক্ষ্যে মোনঘর শিশুসদনে আশ্রিত অনাথ ও দুঃস্থ শিশুদের মধ্যে শিক্ষা দানের উদ্দেশ্যে ১৯৮০ সালে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি ১৯৮২ সালে নিম্ন মাধ্যমিক এবং ১৯৮৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে তৎকালীন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।

মাত্র ১০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৮২ সালের ১ জানুয়ারী থেকে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩০। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। প্রতি বছর বাড়ছে। এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশাপাশি পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম এলাকার শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার আবাসকি ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা রয়েছে। ১২টি ছাত্রাবাস ভবনে ৭০০-এর অধিক শিক্ষার্থীর জন্য আবাসনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

বলা বাহুল্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভৌগলিকভাবে অত্যন্ত দুর্গম। অনেক জায়গায় বিদ্যালয় নেই। অনেক জায়গায় বিদ্যালয় থাকলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নেই। সরকারের ‘সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা’ নীতির কারণে বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলেও বিভিন্ন জায়গায় প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এখনো জুমিয়া পরিবারের অনেক শিশু শিক্ষা সুযোগের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়া কোনো মতে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করতে পারলেও অনেক শিক্ষার্থী নিম্ন মাধ্যমিক অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো গ্রামের কাছাকাছি নিম্ন মাধ্যমিক অথবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকা। অন্যদিকে পার্বত্য অঞ্চলে আবাসিক বিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা নেই। দারিদ্র্যের কারণে অনেক অভিভাবকের পক্ষেও উপজেলা বা জেলা সদরে লজিং বা ঘর ভাড়া করে ছেলেমেয়ে পড়ানো সম্ভব হয় না। দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় এই সমস্যা মেয়েদের জন্যে আরো বেশি প্রকট। এই অবস্থায় আবাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোনঘর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলই অনেক অভিভাবকের কাছে তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার একমাত্র ভরসাস্থল।

তিন পার্বত্য জেলা থেকে সব জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা মোনঘর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পড়তে আসে। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে মোনঘর আবাসিক বিদ্যালয়ে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রান্তিক ছেলেমেয়েরা মোনঘরে ভর্তি হতে আসে। দেখা গেছে, এসব ছেলেমেয়ের যেমন ভাষাগত সমস্যা রয়েছে, তেমনি ঘাটতি রয়েছে তাদের অর্জিত প্রান্তিক যোগ্যতার। দারিদ্র্য তো আছেই। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে শিক্ষকমন্ডলী ও মোনঘরের সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারীরা ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিয়ে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের পেছনে তারা মেধা ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।

মোনঘর কর্তৃপক্ষ মোনঘর রেসিডেন্সিয়াল স্কুলকে ‘স্কুল এন্ড কলেজে’ রূপান্তরিত করে ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শিক্ষার্থীরা এ প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ পাবে।

মোনঘর রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজকে একটি আধুনিক ও যুগোপোযোগী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে একতাবদ্ধভাবে এবং সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

১.২ বিদ্যালয়ের রূপকল্প

শুধু পার্বত্য অঞ্চল নয়, দেশের মধ্যে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাঙ্ক্ষিত একটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সামগ্রিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের মনন ও হৃদয়বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পায়।

১.৩ বিদ্যালয়ের অভিলক্ষ্য

আমরা শিশুদের বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ ও কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহত্তর পরিসরে জনগণকে সম্পৃক্ত করে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। আমাদের রূপকল্প অর্জনের লক্ষ্যে আমরা,

  • সহভাগিতা ও সেবাযত্নমূলক পরিবেশে শিশুকেন্দ্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে পরিপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করি;
  • মনন ও হৃদয়বৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশে উদ্যমী হতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করি;
  • শিক্ষার্থীর নিজের ও অন্য সবার সুখের জন্য প্রকৃত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অন্বেষণ করতে অধ্যবসায়ী হতে শিক্ষাদান করি;
  • নিজেদের একাডেমিক পড়াশুনার গন্ডীর বাইরে সামষ্টিক কল্যাণ ও শান্তির জন্য শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতার শিক্ষাদান করি।

 

১.৪ বিদ্যালয়ের সাংঠনিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ

সাংগঠনিক সংস্কৃতি বলতে সংস্থার মধ্যে কর্মরত সকল কর্মীর সামষ্টিক মূল্যবোধ, আশা-প্রত্যাশা ও আচরণ/অনুশীলনকে নির্দেশ করে, যেগুলোর ভিত্তিতে সংস্থার প্রত্যেক কর্মীর কাজ পরিচালিত হয় এবং কার কী কী করণীয় সেগুলো বলে দেয়। সাংগঠনিক সংস্কৃতি সংস্থার সমস্ত কাজের দিকগুলোকে প্রভাবিত করে। প্রত্যেক কর্মীর সময়নিষ্ঠতা থেকে শুরু করে নিয়মাবলি পালন, চাকরি চুক্তির শর্তাবলী অনুসরণ ও তার সুবিধা অসুবিধা দেখাশুনা করা ইত্যাদি বিষয়াবলির সাথে সাংগঠনিক সংস্কৃতি জড়িত। যে প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক সংস্কৃতি আছে, সে প্রতিষ্ঠানের অন্য যে কোনো সংস্থার চেয়ে বেশি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যে সংস্থার কোনো সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক সংস্কৃতি নেই তার ।

এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সংস্কৃতি নির্ধারণ করা হলো। আমাদের প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নিম্নবর্ণিত মূল্যবোধ আমাদের সমস্ত কাজের এবং শিখন শেখানোর কার্যক্রমে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে:

১.৪.১ আমাদের কাজের পরিবেশ হবে একতাবদ্ধ ও প্রাণবন্ত। এই কথার অর্থ হলো,

  • প্রত্যেকে মনখোলা ও নিজের কাজে প্রত্যেকের কাছে স্বচ্ছ;
  • প্রত্যেকের কাজ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ;
  • প্রত্যেকে নিজের কথায় ও আচরণে অন্য সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল;
  • প্রত্যেকে নেতিবাচক কথা পরিহার করেন; অন্য কারোর সমালোচনা করেন না। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে গঠনমূলক মতামত দেন;
  • এককভাবে নয়, দলীয়ভাবে কাজ করে সংস্থার লক্ষ্য অর্জনে সবাই সচেষ্ট।

 

১.৪.২ আমাদের মূল্যবোধ

১. কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই কথার অর্থ হলো:

  • নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য যে কোন মূল্যে সম্পাদন করতে বদ্ধ পরিকর;
  • সেরা হতে নয়, নিজের কাজে সেরাটা দিতে নিজে প্রতিশ্রতিবদ্ধ;
  • ‘ভালো কাজ ভালো ফল দেয়, খারাপ কাজ খারাপ ফল দেয়’ - এই সত্য মেনে নিয়ে নিজেই নিজের কাজের প্রতি যত্নশীল হওয়া এবং উদ্যমী হওয়া।

২. সক্রিয় যোগাযোগ -এই কথার অর্থ 

  • নিজের কাজের অগ্রগতি কিংবা যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার কর্তৃপক্ষকে অবহিত রাখি;
  • সংস্থার যে কোন নীতি, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি নিয়মিতভাবে পড়ি এবং কোন কিছু করতে বলা হলে দ্রুত সাড়া দিই। কোন কিছু ভালোভাবে না বুঝলে তা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি;
  • কোন বিষয়ে দ্বিমত থাকলে তা স্বাধীন, মুক্ত ও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করি।

৩. অহিংসা -এই কথার অর্থ

  • নিজের আচরণে, বাক্যে ও চিন্তায় কাউকে ক্ষতি করবো না;
  • নিজের কর্মে, শিক্ষায় ও সেবাদানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে কারোর প্রতি বৈষম্য করবো না;
  • সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার ও সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেবো।

৪. শিক্ষার্থীর কল্যাণই প্রথম বিবেচ্য -এই কথার অর্থ

  • আমার সেবায় শিক্ষার্থীর কল্যাণই প্রথম বিবেচ্য। কোন শিক্ষার্থীর সমস্যা থাকলে তা সমাধানে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া আমার প্রথম দায়িত্ব;
  • কোনো শিক্ষার্থী কারোর করুণার পাত্র নয়; বরং নিজের করুণা সহগত চিত্তে তাকে সেবা দেওয়া আমার পবিত্র দায়িত্ব;
  • প্রত্যেক শিশু সমান সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায় -এই বিশ্বাস রেখে তার মধ্যে তার অফুরান সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে তাকে সহযোগিতা করা আমার অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য।

৫. সরলতা ও সততা-এই কথার অর্থ

  • নিজের কাজে নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা;
  • অন্তরে-বাহিরে সব সময় এক থাকা;
  • নিজের কোনো ভুল হলে তা খোলামনে স্বীকার করতে সৎ সাহস রাখা।